গত ৫ ই নভেম্বর মার্কিন নির্বাচনী প্রথা মেনেই নভেম্বর মাসের প্রথম মঙ্গলবার ৬০ তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যেখানে মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান এবং বৃহৎ দুটি দল, একটি ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অপরটি রিপাবলিকান পার্টি - এর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই লক্ষ্য করা গিয়েছিল। তবে অন্যভাবে বলা যায় কমলা হ্যারিসের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইস হাউসের অধিকার নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চোখে পড়ার মতো ছিল । সেখানে অবশ্য শেষমেষ ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে পিছনে ফেলে রিপাবলিকান পার্টি অর্থাৎ কমালা হ্যারিসকে পিছনে ফেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হয় ।এক্ষেত্রে কমলা হ্যারিস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলেক্টোরাল কলেজের মোট ৫৩৮ টি ইলেক্টোরাল ভোটের মধ্যে মোট ২২৬ টি এবং অপরদিকে ডোনাল্ড ট্যাম্প ৩১২ টি সদস্য ভোট পেয়েছে। এরফলে বেশি সংখ্যক ৩১২ সদস্য ভোটে পেয়ে ডোনাল্ড ট্যাম্প জয়ী হন।
তবে এত গেল ২০২৪ -এর কথা। আপনি কী জানেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি। সেই পদ্ধতিই বা কী?
আমি বা আপনি মূলত ভারতীয়রা যেভাবে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন প্রতক্ষ্য ভাবে করে থাকি ,কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমনটি হয় না। এখানে মার্কিন জনগণ পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে থাকেন। আরেকটু বিষয়টি বিস্তারিত ভাবে বলা যাক -
এক্ষেত্রে আগেই বলে রাখা ভালো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি মূলত ৪ বছরের জন্য নির্বাচিত হন । ৪ বছর পর পুনরায় আবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ।
এবারে আসি মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়াটি নিয়ে,
মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়াটি বুঝতে গেলে কয়েকটি ধাপ বা পর্যায়ে বোঝা সম্ভব। সেই পর্যায় বা ধাপগুলো কী কী? আসুন জেনে নিই সেই পর্যায় গুলো-
প্রথম পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে।
প্রথম শর্তটি হল, প্রার্থীকে অবশ্যই জন্ম সূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরীক হতে হবে,
দ্বিতীয় শর্তটি অনুয়ায়ী প্রার্থীর বয়স অন্তত ৩৫ বছর হবে। এবং
তৃতীয় শর্তটি হল অন্তত ১৪ বছর যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে মার্কিন সেনাবাহীনী জন্য শেষ তৃতীয় শর্তটি ব্যতিক্রম ।
এবার আসা যাক দ্বিতীয় পর্যায়ে, যেখানে প্রার্থীর যোগ্যতা নিয়ে। এ ব্যাপারে ইলিয়ন স্টেটের ডেপল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়েন স্টেগার ডয়চে ভেলেকে বলেন, প্রাপ্ত বয়স্ক যে কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন । এমনকি দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিরও প্রার্থী হতে কোনো বাধা নেই। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে আলাদা বিধান রয়েছে। যাতে রাজনৈতিক বন্দিরাও বঞ্চিত না হয় প্রার্থী হওয়া থেকে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৪ তম সংশোধনীতে বলা হয়েছে যে, রাজনৈতিক পদে থাকা কোনো ব্যক্তি দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যুক্ত হলে বা শত্রুদের সহায়তা করলে সে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন । অর্থাৎ সে প্রার্থী হতে পারবেন না।
এর পরের পর্যায়ে হল প্রাইমারী ও ককাস । আসলে এই প্রাইমারী ও ককাসের মাধ্যমে মূল প্রতিদ্বন্দিতায় প্রার্থীর সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়। মার্কিন লড়াই এর ময়দান উন্মুক্ত থাকলেও এই দুই পদ্ধতিতে দল গুলো তাদের প্রার্থী বাছাই করে এবং প্রার্থীর সংখ্যা কমিয়ে আনে। এক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় নির্বাচনী বছরের বসন্তের শুরুর দিকে ।
তবে এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো যে, মূলত প্রাইমারী পদ্ধতিতে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে দলের নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে থাকে। আর ককাস পদ্ধতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ টি অঙ্গরাজ্যের সদস্যরা একত্রে উপস্থিত হয়ে ভোটের মাধ্যমে নিজেদের প্রার্থী বাছাই করেন।
এক্ষেত্রে প্রাইমারির চেয়ে ককাসে পদ্ধতিটি একটু ঝক্কির। তবে প্রাইমারী ও ককাস কিন্তু একই কাজ করে অর্থাৎ এ সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রার্থী নির্বাচন করে থাকে ।
এর পরের পর্যায়টি হল জাতীয় কনভেনশনের ভূমিকা। এই জাতীয় কনভেনশনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রার্থী এবং রানিং মেট বা উপরাষ্ট্রপতির জন্য প্রার্থী নির্বাচন করা হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ টি অঙ্গরাজ্যের ডেলিগেট বা প্রতিনিধির সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন প্রার্থীকে পেতে হয়।
এই ডেলিগেট বা প্রতিনিধির মধ্যেও দুটি ভাগ রয়েছে। যেমন ডেমোক্র্যাটদের ক্ষেত্রে বলা হয় প্লেজড বা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং আনপ্লেজড বা অপ্রতিশ্রুতিবদ্ধ । আবার রিপাবলিক পার্টির ক্ষেত্রে বাউন্ড বা বাধ্যতামূলক এবং আনবাউন্ড বা অবাধ্যতামূলক প্রতিনিধি বা ডেলিট রয়েছে।
যেখানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও বাধ্যতামূলক প্রতিনিধিরা কেবলমাত্র অঙ্গরাজ্য থেকে প্রাইমারিতে জিতে আসা প্রার্থীকেই ভোট দিতে পারেন।
তবে অপ্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও অবাধ্যতামূলক প্রতিনিধিরা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন।
এরপর আসে কনভেনশনের নির্বাচন প্রক্রিয়া জাতীয় কনভেনশনের পর্ব কাটার পরই নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়। নির্বাচনের দিনে দেশজুড়ে রীতিমতো কয়েক হাজার শহরে ভোট প্রক্রিয়া চলে। নিবন্ধিত যে কোনো মার্কিন নাগরিক এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিজের ভোটদানের মাধ্যমে অংশ নিতে পারেন। মার্কিন জনগন তাদের ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধিদের নির্বাচন করে থাকেন।
এরপর সবচেয়ে পুরত্বপূর্ণ ও শেষের পর্যায়টি হল ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ । এই ইলেকটোরাল কলেজের মাধ্যমেই মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন , বলা ভালো মার্কিন প্রেসিডেন্ট কে হবেন তা নির্ধারন করে এই ‘ইলেকটোরাল কলেজ'। ইলেকটোরাল কলেজে মোট ৫৩৮ জন ইলেকটর নির্বাচিত হয় । এরপর তারাই সবশেষে নির্ধারণ করেন, মার্কিন রাষ্ট্রপতি কে হবেন।
এক্ষেত্রে ইলেকটোরাল সংখ্যা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের উভয়কক্ষের ইলেক্টোরাল সংখ্যা । অর্থাৎ নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ বা হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ ও কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে সদস্য সংখ্যা । তবে এক্ষেত্রে প্রতিনিধি পরিষদ বা হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ ইলেক্টোর সংখ্যা নির্ভর করে মার্কিন অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার ওপর এক্ষেত্রে প্রতিনিধি পরিষদ বা হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ মোট ৪৩৫ টি ইলেক্টোরাল ভোট।এক্ষেত্রে ক্যালিফোর্নিয়ায় সবচেয়ে বেশি ইলেক্টোরাল ভোট রয়েছে মোট ৫৪ টি ইলেক্টোরাল ভোট। অপরদিকে কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে প্রতি অঙ্গরাজ্যের থেকে দুটি করে করে প্রতিনিধি থাকে । ৫০ টি অঙ্গরাজ্য থেকে ২ জন করে মোট ১০০ টি ইলেক্টোরাল ভোট।
সবমিলিয়ে ৫০টি রাজ্যের রিপ্রেজেনন্টেটিভ ৪৩৫ জন ও সিনেটের ১০০ জন। এছাড়া ডিজিস্ট্রট অব কলম্বিয়ার ৩ টি ইলেক্টোরাল ভোট। এই সমস্ত মিলিয়ে ৫৩৬ টি ইলেক্টোরাল ভোট।
এক্ষেত্রে নির্বাচনে কোনো প্রার্থীকে জয়ী হতে গেলে সংখ্যাগরিষ্টতা পেতে হয়। এক্ষেত্রে অন্তত ২৭০ টি ইলেকটোরাল ভোট পেতে হয়।
তবে এক্ষেত্রে আরেকটু বলে রাখা ভালো মার্কিন আইনানুসারে নিয়মানুসারে ,মেইন এবং নেব্রাস্কা ছাড়া বাকি অঙ্গরাজ্যগুলিতে 'উইনার টেকস অল’ ভিত্তিতে ভোট নির্ধারিত হয়ে থাকে। এর অর্থ হল কোনো প্রার্থী যে রাজ্যে এগিয়ে আছে থাকবেন, তিনি সেই রাজ্যের সবগুলি ভোট বা ইলেকটরের সমর্থন পাবেন।
সবশেষে নতুন বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারী মাসে রাষ্ট্রপতি শপথ গ্রহণ করেন। আর এভাবেই মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়।
Contributed by:
Nimai Sarkar
Nimai is a Fifth semester students studying Political Science Hons. at Maynaguri College.
Source: প্রথম আলো
Link: https://www.prothomalo.com/world/usa/y9tzlck9w3
Image Courtesy: https://images.app.goo.gl/86pEKYTZ6QcAWViF7